একনজরে কুমিল্লা
কুমিল্লা জেলা বাংলাদেশের দক্ষিণ-পূর্বাঞ্চলের চট্টগ্রাম বিভাগের একটি প্রশাসনিক অঞ্চল। ঐতিহ্য, সংস্কৃতি এবং অর্থনৈতিক গুরুত্বের দিক থেকে এটি বাংলাদেশের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ জেলা। এখানে কুমিল্লার প্রধান পরিসংখ্যান এবং প্রশাসনিক তথ্য তুলে ধরা হলো, যা এই অঞ্চলের সামগ্রিক পরিচিতি প্রদান করে।
আয়তন
৩০৮৩.৩৩ বর্গ কি.মি.
মোট জনসংখ্যা
৬২,১১,৯১৫ জন
উপজেলা
১৭টি
সিটি কর্পোরেশন
০১টি
পৌরসভা
০৮টি
ইউনিয়ন
১৯৩টি
বিশ্ববিদ্যালয়
০১টি
শিক্ষার হার
৭৪.৮%
পৌরসভা শ্রেণীবিভাগ
স্বাস্থ্যকেন্দ্রের ধরণ
ইতিহাস ও পটভূমি
কুমিল্লার ইতিহাস অত্যন্ত প্রাচীন এবং সমৃদ্ধ। প্রাচীনকালে এটি সমতট জনপদের একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ ছিল। বহু রাজবংশ, যেমন—দেব, চন্দ্র, এবং খড়গ বংশ এখানে রাজত্ব করেছে। এই অঞ্চলের ভৌগোলিক গঠন এবং ঐতিহাসিক বিবর্তন এটিকে এক অনন্য পরিচয় দিয়েছে, যা এই বিভাগে তুলে ধরা হয়েছে।
প্রাচীন যুগ (৫ম-১২ শতক)
প্রাচীন সমতট জনপদের অন্তর্গত ছিল। ৫ম শতকে গুপ্ত সম্রাটদের অধীনে আসে। পরবর্তীতে দেববংশ, চন্দ্রবংশ ও হরিকেল রাজারা শাসন করেন। ৭ম শতকে পরিব্রাজক হিউয়েন সাং ও ইৎসিঙ এই অঞ্চল ভ্রমণ করেন।
মধ্যযুগ (১৩-১৮ শতক)
১৩ শতকে কুমিল্লা মুসলিম শাসনের অধীনে আসে। সুলতান শামসুদ্দিন ফিরোজ শাহের সময় এর অধিকাংশ এলাকা মুসলিম শাসনে আসে। পরবর্তীতে এটি ত্রিপুরা রাজাদের অধিকারে যায় এবং মোগলদের সাথে তাদের সংঘাত চলতে থাকে।
ব্রিটিশ আমল (১৭৬১-১৯৪৭)
পলাশী যুদ্ধের পর ১৭৬১ সালে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির অধীনে আসে। ১৭৯০ সালে ত্রিপুরা জেলা প্রতিষ্ঠিত হয়। ১৯৬০ সালে জেলার নামকরণ 'কুমিল্লা' করা হয়।
পাকিস্তান আমল ও স্বাধীনতা
১৯৪৭ সালে দেশভাগের পর পূর্ব পাকিস্তানের অংশে পরিণত হয়। ধীরেন্দ্রনাথ দত্ত কর্তৃক গণপরিষদে বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা করার দাবি উত্থাপন এই জেলার এক ঐতিহাসিক ঘটনা। ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধে কুমিল্লার অবদান অনস্বীকার্য।
ঐতিহাসিক ও প্রত্নতাত্ত্বিক স্থান
কুমিল্লা জেলা প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শনে অত্যন্ত সমৃদ্ধ। শালবন বিহার থেকে শুরু করে প্রাচীন মন্দির এবং মসজিদ—এই অঞ্চলের প্রতিটি কোণায় লুকিয়ে আছে ইতিহাসের অমূল্য সম্পদ। এই বিভাগে কুমিল্লার সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ঐতিহাসিক স্থানগুলোর সংক্ষিপ্ত পরিচিতি দেওয়া হলো, যা পর্যটক ও গবেষকদের জন্য আকর্ষণীয়।
শালবন বিহার
৭ম-৮ম শতকে দেববংশের রাজা শ্রীভবদেব নির্মিত একটি বৌদ্ধ বিহার। এখানে ১৫৫টি ভিক্ষুকক্ষ এবং একটি কেন্দ্রীয় মন্দির রয়েছে।
আনন্দ বিহার
বাংলাদেশে আবিষ্কৃত দ্বিতীয় বৃহত্তম বিহার। ৭ম-৮ম শতকে দেব বংশের শাসক শ্রী আনন্দ দেব এটি নির্মাণ করেন।
ময়নামতি জাদুঘর
১৯৬৫ সালে প্রতিষ্ঠিত। ময়নামতি অঞ্চল থেকে প্রাপ্ত প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শন এখানে সংরক্ষিত আছে। ৫০০ কেজি ওজনের ব্রোঞ্জের ঘণ্টাটি অন্যতম আকর্ষণ।
চণ্ডীমুড়া মন্দির
লালমাই পাহাড়ের চূড়ায় অবস্থিত একটি প্রাচীন মন্দির। ৭ম শতকে খড়গ বংশীয় রাজার হিন্দু রানী এটি নির্মাণ করান।
শাহসুজা মসজিদ
পুরাতন গোমতী নদীর তীরে অবস্থিত একটি মোগল স্থাপত্যের নিদর্শন। শাহ সুজা এটি নির্মাণ করেন বলে প্রচলিত আছে।
ময়নামতি ওয়ার সিমেট্রি
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে নিহত কমনওয়েলথ সৈন্যদের সমাধিক্ষেত্র। এখানে ৭৩৭ জন সৈনিকের কবর রয়েছে।
মুক্তিযুদ্ধে কুমিল্লা
বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামে কুমিল্লার অবদান অবিস্মরণীয়। এই জেলা ছিল ২নং সেক্টরের অধীনে এবং এখানে অসংখ্য সম্মুখ যুদ্ধ ও প্রতিরোধ গড়ে উঠেছিল। এই বিভাগে কুমিল্লার বীর মুক্তিযোদ্ধা, গুরুত্বপূর্ণ যুদ্ধ এবং পাকবাহিনীর চালানো গণহত্যার সংক্ষিপ্ত বিবরণ তুলে ধরা হয়েছে, যা আমাদের মুক্তিযুদ্ধের এক গৌরবময় অধ্যায়কে স্মরণ করিয়ে দেয়।
খেতাবপ্রাপ্ত মুক্তিযোদ্ধা
গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা ও স্থান
- দেবিদ্বারের প্রতিরোধ: ৩১ মার্চ, ১৯৭১, স্থানীয় জনতা পাক সেনাদের বিরুদ্ধে প্রথম প্রতিরোধ গড়ে তোলে।
- পুলিশ লাইন আক্রমণ: ২৫ মার্চ রাতে পাকবাহিনী কুমিল্লা পুলিশ লাইন আক্রমণ করে, যেখানে ৩১ জন পুলিশ সদস্য শহীদ হন।
- গণহত্যা: ময়নামতি সেনানিবাস, ইস্পাহানি পাবলিক স্কুল, সার্ভে ইনস্টিটিউটসহ বিভিন্ন স্থানে ব্যাপক গণহত্যা চালানো হয়।
- বধ্যভূমি: জেলায় ১২টিরও বেশি পরিচিত বধ্যভূমি রয়েছে, যা পাকবাহিনীর নৃশংসতার সাক্ষী।
- শহর মুক্ত: ৮ ডিসেম্বর, ১৯৭১ কুমিল্লা শহর শত্রুমুক্ত হয়।
ঐতিহ্য ও সংস্কৃতি
কুমিল্লার সংস্কৃতি ও ঐতিহ্য অত্যন্ত সমৃদ্ধ এবং বৈচিত্র্যময়। এখানকার খাদি শিল্প, রসমালাই এবং মৃৎশিল্প বিশ্বজুড়ে পরিচিত। পাশাপাশি, বিভিন্ন ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীর উপস্থিতি এই অঞ্চলের সাংস্কৃতিক অঙ্গনকে আরও বর্ণময় করে তুলেছে। এই বিভাগে কুমিল্লার প্রধান ঐতিহ্যবাহী পণ্য এবং সাংস্কৃতিক উপাদান সম্পর্কে আলোচনা করা হয়েছে।
কুমিল্লার খাদি
মহাত্মা গান্ধীর স্বদেশী আন্দোলনের সময় জনপ্রিয়তা লাভ করে। হাতে কাটা সুতা দিয়ে তৈরি এই বস্ত্র কুমিল্লার এক গর্বের প্রতীক।
রসমালাই
উনিশ শতকে ঘোষ সম্প্রদায়ের হাত ধরে এর প্রচলন। দুধের ক্ষীর এবং ছোট রসগোল্লার সমন্বয়ে তৈরি এই মিষ্টান্নটি কুমিল্লার পরিচয় বহন করে। মাতৃভান্ডার এর জন্য বিখ্যাত।
বিজয়পুরের মৃৎশিল্প
বিজয়পুর গ্রামের রুদ্রপাল সম্প্রদায়ের তৈরি মৃৎশিল্পের খ্যাতি দেশজোড়া। এখানকার কলসি, হাঁড়ি, পাতিল ও বিভিন্ন খেলনা বিখ্যাত।
বিখ্যাত ব্যক্তিত্ব
কুমিল্লা জেলা বহু জ্ঞানী-গুণী ও বিখ্যাত ব্যক্তির জন্মস্থান। রাজনীতি, সঙ্গীত, সমাজসেবা এবং মুক্তিযুদ্ধে তাঁদের অবদান অনস্বীকার্য। এই বিভাগে কুমিল্লার কয়েকজন কৃতি সন্তানের সংক্ষিপ্ত পরিচিতি তুলে ধরা হলো, যারা জাতীয় ও আন্তর্জাতিক পর্যায়ে খ্যাতি অর্জন করেছেন।
ধীরেন্দ্রনাথ দত্ত
ভাষাসৈনিক ও রাজনীতিবিদ
নওয়াব ফয়জুন্নেসা
নারী শিক্ষার পথিকৃৎ ও নবাব
শচীন দেব বর্মণ
কিংবদন্তী সঙ্গীতশিল্পী ও সুরকার
ড. আখতার হামিদ খান
সমাজবিজ্ঞানী ও BARD-এর প্রতিষ্ঠাতা
মেজর আব্দুল গনি
ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের প্রতিষ্ঠাতা
বুদ্ধদেব বসু
সব্যসাচী লেখক ও কবি
শিব নারায়ণ দাশ
জাতীয় পতাকার অন্যতম নকশাকার
গাজী মাজহারুল আনোয়ার
বিখ্যাত গীতিকার
নদ-নদী ও জলাশয়
কুমিল্লা একটি নদীমাতৃক অঞ্চল। মেঘনা, গোমতী, ডাকাতিয়া এবং ছোট ফেনীসহ অসংখ্য নদ-নদী এই জেলার উপর দিয়ে প্রবাহিত হয়েছে, যা এই অঞ্চলের কৃষি ও অর্থনীতিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। এই বিভাগে প্রধান নদ-নদী এবং উল্লেখযোগ্য বিল ও জলাশয় সম্পর্কে তথ্য প্রদান করা হলো।
গোমতী নদী
ত্রিপুরার ডুম্বুর থেকে উৎপন্ন হয়ে কুমিল্লায় প্রবেশ করেছে। একসময় 'কুমিল্লার দুঃখ' বলা হলেও এখন এটি আশীর্বাদ।
ডাকাতিয়া নদী
ত্রিপুরার পাহাড়ী অঞ্চল থেকে উৎপন্ন হয়ে লালমাই পাহাড়ের পাশ দিয়ে প্রবাহিত হয়েছে।
মেঘনা নদী
ভৈরব বাজারের কাছে নামধারণ করে জেলার পশ্চিম সীমানা দিয়ে প্রবাহিত হয়েছে।
উল্লেখযোগ্য বিল
তৃষ্ণা বিল (নাঙ্গলকোট), ভারেল্লা বিল (বুড়িচং), এবং ঘুমরা জলা (চান্দিনা-কচুয়া) এই অঞ্চলের প্রধান জলাশয়।